ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫ , ১৬ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিদ্যুতে মাফিয়াদের বর্তমান হালচাল!

ডেস্ক রিপোর্ট
আপলোড সময় : ২৬-০১-২০২৫ ১১:৩২:২৮ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় : ২৬-০১-২০২৫ ০১:০৭:৩৯ অপরাহ্ন
বিদ্যুতে মাফিয়াদের বর্তমান হালচাল! প্রতীকী ছবি
দেড় দশকে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন টানা বাড়লেও তা গুটিকয়েক দেশি-বিদেশি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত এসব কোম্পানি এর বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এছাড়া ভারতের নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে উৎপাদন সক্ষমতার একটি অংশ। উচ্চ ব্যয়ের এসব কেন্দ্রের কারণে দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় গড়ে তিন টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ টাকা। এ সময় দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলো এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে যায়।

যদিও ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পরও এদের নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বরং এসব কোম্পানি বহাল তবিয়তেই আছে। এমনকি এদের সঙ্গে সম্পাদিত বেশিরভাগ চুক্তি খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। অথচ কোনো ধরনের পর্যালোচনা ছাড়াই গত মঙ্গলবার এসব কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম তথা ট্যারিফ পর্যালোচনায় কমিটি করা হয়েছে। এতে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো বাড়তি সুযোগ পাবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণ সামিট গ্রুপের হাতে। এ গ্রুপের অধীনে বর্তমানে ১৪টি ছোট-বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। দেড় দশকে গ্রুপটি ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে ১৪ হাজার ৮৫৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর বাইরেও কেপিসিএলের ৩৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সামিটের কাছে, যার জন্য পৃথক ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে কোম্পানিটি।

তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ মালিকানাধীন এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মাত্র তিন বছরেই ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে ১২ হাজার ৪২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে দেশীয় ইউনাইটেড গ্রুপ। বর্তমানে এ গ্রুপটির সাতটি নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। তবে পাঁচটি থেকে পিডিবি সরাসরি বিদ্যুৎ কেনে। এজন্য ১৫ বছরে গ্রুপটি ১০ হাজার এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে। ইউনাইটেড গ্রুপের বাকি দুটি কেন্দ্র সরাসরি বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে। এজন্য কোনো ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় না। এছাড়া গ্রুপটির কাছে কেপিসিএলের ৩৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে, যার জন্য পৃথক ক্যাপাসিটি চার্জ পায় তারা।

যুক্তরাজ্যের এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। এ কোম্পানিটি ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে মোট সাতটি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যেই সবগুলো কেন্দ্র অবসরে চলে গেছে। গত দেড় দশকে বাংলাদেশ থেকে মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে এগ্রিকো, যার পরিমাণ আট হাজার ৩৩০ কোটি ২৫ লাখ টাকা। মালয়েশিয়াভিত্তিক সিডিসি এনার্জি ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে সাত হাজার ৯৭৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এ কোম্পানির দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৮১০ মেগাওয়াট। দুটিই অবসরে চলে গেছে।

ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে দেশীয় বাংলা ক্যাট। এ গ্রুপের এক সময় পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও বর্তমানে মাত্র একটি উৎপাদনে রয়েছে। বাকিগুলো গত দুই বছরে অবসরে গেছে। পাঁচটি কেন্দ্রের জন্য গ্রুপটি মোট ছয় হাজার ৩১২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে। এছাড়া প্যারামাউন্ট বি. ট্র্যাক ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪৯ শতাংশ রয়েছে বাংলা ক্যাটের হাতে। এজন্য পৃথক ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে গ্রুপটি।

তালিকায় সপ্তম অবস্থানে থাকা রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) মূলত পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের মালিকানাধীন পাঁচটি সমিতির অধীনে গড়ে ওঠা। এ কোম্পানিটির বর্তমানে চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ৩৯২ মেগাওয়াট। ১৫ বছরে এ কোম্পানির পকেটে গেছে পাঁচ হাজার ৯৯১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এদের আরও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে।

ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় নির্মিত আদানি পাওয়ার ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে অষ্টম স্থানে রয়েছে। ভারতে নির্মাণ করা হলেও কেন্দ্রটিকে বাংলাদেশে নির্মিত যে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে বেশি আর্থিক সুবিধা দেয়া হয়েছে। ক্যাপাসিটি চার্জও ধরা হয়েছে অনেক বেশি হারে। এতে কেন্দ্রটি মাত্র ১৫ মাসেই ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে পাঁচ হাজার ৬১৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। কয়েক বছরের মধ্যে এটি হয়ে যাবে দেশের শীর্ষ ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়কারী কোম্পানি।

তালিকায় নবম স্থানে রয়েছে দেশীয় ওরিয়ন গ্রুপ। পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র এক সময় উৎপাদনে থাকলেও দুটি অবসরে চলে গেছে। এর মধ্যে একটি সৌরবিদ্যুতের, যার জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ নেই। সব মিলিয়ে ওরিয়ন গ্রুপ দেড় দশকে মোট পাঁচ হাজার ৩৭৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে। আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কেপিসিএলের (খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড) তিনটি কেন্দ্রের সবগুলোই অবসরে গেছে। তবে সব মিলিয়ে এ কোম্পানিটি ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে চার হাজার ৪৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এছাড়া পায়রায় ইউনাইটেড গ্রুপের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে কেপিসিএলের কাছে, যার জন্য পৃথক ক্যাপাসিটি চার্জ পায় কোম্পানিটি।

তালিকায় থাকা অন্যান্য গ্রুপ বা কোম্পানির ক্যাপাসিটি চার্জ চার হাজার কোটি টাকার নিচে। সব মিলিয়ে ২০০৯-১০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৫ বছরে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় এক লাখ ৩৭ হাজার ৩৭৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। আর ২০০৯-১০ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল তিন টাকা আট পয়সা। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছর এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ টাকা চার পয়সা।

এদিকে হাসিনার পতনের প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস পর বিদ্যুতের দাম (ট্যারিফ) পর্যালোচনায় কমিটি করল সরকার। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে চুক্তি পর্যালোচনায় কমিটি করা হয়েছিল। ওই কমিটির মতামতের ভিত্তিতেই ট্যারিফ পর্যালোচনা কমিটি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মো. কামরুল আহসানকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব (উন্নয়ন-১) মোহাম্মদ সোলায়মান। অন্য চার সদস্য হলেন Ñপাওয়ার সেলের কনসালট্যান্ট তোহা মোহাম্মদ, সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মনজুর আলম, পিডিবির সদস্য (অর্থ) অঞ্জনা খান মজলিশ ও পিডিবির পরিচালক (ক্রয় পরিদপ্তর) মো. নান্নু মিয়া।

কমিটির কার্যপরিধি সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাতিল করা বিশেষ বিধান আইনের (দায়মুক্তি আইন) অধীনে সম্পাদিত চুক্তিগুলোর ট্যারিফ কাঠামো পর্যালোচনা ও সুপারিশ করা এবং বিশেষ বিধান আইনের অধীনে করা ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তিগুলো পুনরায় আলোচনা (নেগোসিয়েশন) ও সুপারিশ দেয়া। প্রয়োজনে অভিজ্ঞ কোনো সদস্যকে কমিটিতে যুক্ত করা যাবে বলেও জানানো হয়েছে। চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে ট্যারিফ কাঠামোয় অনেকগুলো ব্যাপার আছে। এসব বিষয় নিয়ে দরকষাকষির বিষয় আছে। তাই তারা একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছেন। এছাড়া বিদেশি আইনি পরামর্শক নিয়োগেরও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।তবে ট্যারিফ পর্যালোচনা কমিটি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, দরকষাকষির মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের সুযোগ তৈরি করে দেয়া হচ্ছে। এত বছরে তারা কী পরিমাণ বাড়তি মুনাফা নিয়ে গেছে, সেই হিসাব করতে হবে আগে। এরপর তা সমন্বয় করে আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে রাজি হলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দরকষাকষি হবে, না হলে চুক্তি বাতিল করতে হবে।

বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এনআইএন

সূত্র: শেয়ার বিজ


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স


এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ